বৃহস্পতিবার ১৪ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানের কর্মী থেকে যেভাবে তিনি আলীরাজ হয়ে উঠেন

  |   বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   45 বার পঠিত

প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানের কর্মী থেকে যেভাবে তিনি আলীরাজ হয়ে উঠেন

সংগৃহীত ছবি

সিরাজগঞ্জের ধানবান্দিতে ধুলোমাখা শৈশব-কৈশোর কেটেছে। বিকেল হলেই দৌড়ে যেতাম খেলার মাঠে। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-আনন্দে কাটত সেই সব দিন। অভিনয়ের পোকা মাথায় ঢুকেছিল শৈশবেই। ১৯৭৪ সালের কথা বলছি। মঞ্চে নিজের অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটত। পাশাপাশি অন্যের নাটকের রিহার্সেলও দেখতাম। এ কারণে সবসময়ই ছিলাম মঞ্চমুখী। সিরাজগঞ্জের ‘দুর্বার’ নাট্যগোষ্ঠীতে কেটেছে অনেক লম্বা সময়। মঞ্চে কাজ করতে করতেই সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছা জাগে। দেখতে একটু সুদর্শন ছিলাম বলে অনেকেই চাইতেন আমি যেন সিনেমায় অভিনয় করি। আমার ছোটবেলার বন্ধু আনোয়ার হোসেন বুলু লেখাপড়ার জন্য একসময় ঢাকায় চলে আসে। তার দুলাভাই ক্যামেরাম্যান আবদুল লতিফ বাচ্চুর বাসায় ওঠে। ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাকে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনবে বলে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে সিট বরাদ্দ নেয় সে। তখন তো ফোন ছিল না। ডাব্লিউ তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তুমি চলে এসো– এমনটা জানিয়ে আমাকে ঢাকায় আসার জন্য চিঠি লিখে বন্ধু। ওই সময় আমি ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট-অলিগলি কিছুই চিনতাম না। ১৯৭৬ সালে মুহসীন হলে উঠি ‘বহিরাগত’ হিসেবে।

দুলা ভাইয়ের সঙ্গে সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে পুরোদমে কাজ করছে বুলু। তখন আমিও টুকটাক কাজ খোঁজার চেষ্টা করি। ঢাকা প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি পেয়ে যাই। চাকরির পাশাপাশি ঢাকার সংলাপ গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিই। পরবর্তী সময়ে ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত হয়েছি। শেষ পর্যন্ত এ নাট্যদলের সঙ্গেই কেটেছে দীর্ঘ সময়। একসময় বুলু ক্যামেরাম্যান হিসেবে বিটিভিতে যোগদান করেন। তখন থেকেই তার চিন্তা আমাকে কীভাবে বিটিভিতে ঢোকাবে। এদিকে ঢাকায় চলছে আমার মেসজীবন। আমি চাকরির পাশাপাশি ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হই। খুব পরিশ্রম করছি। একদিন মেসে এসে বুলু বলল, ডাব্লিউ তোমাকে বিটিভিতে অডিশন দিতে হবে। ফরম বুলুই পূরণ করে জমা দিয়েছে বিটিভিতে। আমার ডাক নাম ডাব্লিউ। পুরো নাম আনোয়ার হোসেন। ডাব্লিউ আনোয়ার নাম দিয়ে ফরম পূরণ করে দিয়ে বুলু বলল, বিটিভিতে কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে ডাব্লিউ আনোয়ার। প্রথমবার বিটিভিতে গিয়ে দেখি– আবদুল্লাহ আল মামুন, গোলাম মুস্তাফা, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোস্তাফিজুর রহমানের মতো গুণী ব্যক্তিরা বসা। দুরুদুরু বুকে সেখানে ঢুকলাম। ইন্টারভিউ দিলাম। আমি যতটা নার্ভাস ছিলাম তার চেয়ে বেশি ছিল বুলু। দু’দিন পরে সে আমাকে বলল, তুমি তো পাস করেছ। তখন বিটিভিতে অভিনয় করা ছিল বড় ব্যাপার। এরপর ক্যামেরা অডিশনেও পাস করি। অডিশন প্যানেলে যারা ছিলেন তারা বুলুকে বলেছিলেন– ‘এইড্যা কারে নিয়া আইছো। এই ছেলে তো মারাত্মক।’ এরপর শুরু হলো আমার বিটিভি যাত্রা। ১৯৮২ সালে ‘আয়না’ সিরিজের ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ নাটকে প্রথম অভিনয় করি। পরে একই সিরিজের ‘লাল মাটি কালো ধোঁয়ায়’ও অভিনয় করেছি। টিভির সাদাকালোর যুগ। মানুষ আমাকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করে। তখন ফরীদি ভাই [হুমায়ুন ফরীদি] টিভি নাটকের ব্যস্ত শিল্পী। দু’জন রাস্তায় বের হলেই মানুষ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ওই যে ডাব্লিউ আর হুমায়ুন ফরীদি যাচ্ছে। টিভিতে একক নাটক করেছি প্রায় ৩০টির মতো। এর মধ্যে ‘নায়ক’, ‘রুমঝুম’ নাটক দুটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। আমার অভিনীত সর্বশেষ ধারাবাহিক ছিল ‘ঢাকায় থাকি’। টানা দেড় বছর কাজ করেছি। এক ঘণ্টার এ নাটকটি দর্শক বেশ গ্রহণ করেছিল। এ নাটকে সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলাম গীতিকার রফিকুজ্জামানকে। কাজের সুবাদে তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। তিনি আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। ওই সময় টিভি ও মঞ্চে সমানতালে অভিনয় করছি। মনে হলো, সিনেমায় অভিনয় করলে তো এগুলো সব ছেড়ে দিতে হবে। এর আগে মিতা দাদাও [নারায়ণ ঘোষ মিতা] আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন না করেছি। একের পর এক সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকে। রফিক ভাই আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য আবারও তাড়া দিলেন। তাঁকে বলেছি, আমাকে কয়েকদিন চিন্তা করার সময় দিন। তিনি আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে জানাতে বললেন। এরপর তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বললাম। জানতে চাইলাম সিনেমার নায়ক কে? সিনেমাটা কার? বললন, নায়করাজ রাজ্জাক। গল্প ও চরিত্রের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বললেন, আপনিই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করবেন। সিনেমার নাম ‘সৎ ভাই’। এটি সাহিত্যনির্ভর কাজ।

যাকে দেখে ছোট থেকে বড় হয়েছি, এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছি ভেবে ভালোই লাগছিল। সিনেমায় তিনি [রাজ্জাক] আমার বড় ভাই, আমি ছোট ভাই বিষয়টিই অন্যরকম। কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হলাম। এরপর রাজ্জাক ভাই তাঁর বসায় আমাকে চায়ের দাওয়াত দিলেন। গেলাম সেখানে। ওই সময়ই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তাঁকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো। ড্রইং রুমে বসেছিলাম। ভেতর থেকে পরিবারের সবাই আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন। লজ্জা পাচ্ছিলাম। এ সময় রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় রফিক ভাইও ছিলেন। রাজ্জাক ভাই তাঁকে বললেন, আমার বাড়ির সবাই ডাব্লিউ আনোয়ারের অভিনয়ে মুগ্ধ। ডাব্লিউ বাসায় এসেছে বলে সবার মুখে খুশির ঝিলিক। লক্ষ্মী ভাবি [নায়ক রাজ্জাকের স্ত্রী] ‘ঢাকাই থাকি’ ধারাবাহিক খুব পছন্দ করতেন। যে জন্য তাঁর কাছে আমার আলাদা কদর ছিল।

বিশাল আয়োজন শুটিং ‘সৎ ভাই’-এর দৃশ্যধারণ শুরু হলো। এসব দেখে আমার মনে হলো ফিল্ম মহাসমুদ্র, সে সমুদ্রে সবাই একবার স্নান করতে চান। স্বল্প বাজেটের সাদাকালো সিনেমাটি ১৯৮৪ সালের ঈদে মুক্তি পেয়েছিল। ওই সময় এটি ছিল ব্যবসা সফল সিনেমা। ক্যারিয়ারে প্রায় ৫০০ সিনেমায় অভিনয় করেছি। আনোয়ার হোসেন বুলু যদি আমাকে ডাব্লিউ আনোয়ার না বানাত, তাহলে আমি আলীরাজ হতে পারতাম না। সে যখন সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে ২০ টাকা যাতায়াত ভাতা পেত, সেখান থেকে ১০ টাকা আমার খরচের জন্য রাখত। তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ‘সৎ ভাই’ আমার অভিনয় ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট। এ সিনেমার মাধ্যমেই দর্শকের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। এটি মুক্তির পর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সিনেমাটিকে ঘিরে অনেক স্মৃতিও আছে। আমার আলীরাজ নামটিও দিয়েছেন রাজ্জাক ভাই। প্রথম সিনেমার শুটিংয়ে রাজ্জাক ভাই বললেন, তোমার নামটা আমি দেব। আমি রাজি হলাম। অনেকদিন শুটিং করেছি কিন্তু আমি জানিও না তিনি কী নাম রেখেছেন। আমাকে চমকে দিতে চেয়েছেন তিনি। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর সবাই মিলে সিনেমা দেখতে গেলাম। পর্দায় ভেসে উঠল আলীরাজ নামটি। নামটি আমার পছন্দ হয়েছে। এ কারণে খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। নায়ক থেকে ভিলেন, বাবা, চাচা কিংবা পরিবারের কর্তা– সব চরিত্রেই দর্শক আমাকে গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও সবাই আমাকে ভালোবাসেন। আমাকে নিয়ে কাউকে কোনোদিন নেতিবাচক কথা বলতে শুনিনি। দর্শক ও মিডিয়াকর্মীদের ভালোবাসার আমি ধন্য। একজীবনে অনেক পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অভিনয়ই আমার ধ্যান-জ্ঞান। অভিনয়ের জন্য এখনও হোমওয়ার্ক করি। প্রতিনিয়ত শিখছি। আমৃত্যু অভিনয় করে যেতে চাই। জীবনে আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। স্রষ্টার কৃপায় সুন্দর পৃথিবী দেখলাম– এটি জীবনের পরম পাওয়া।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১২:২৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

bankbimarkhobor.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

[abm_bangladesh_map]
advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
মোঃ ইসলাম শেখ
কার্যালয়

৭৯, সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড, (৩য় তলা, বাম দিক), সিদ্ধেশ্বরী, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭

01760742336

[email protected]