শুক্রবার ১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

স্বপ্ন আজ বাস্তব, গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তা

অর্থনীতি ডেস্ক   |   বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   91 বার পঠিত

স্বপ্ন আজ বাস্তব, গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তা

সংগৃহীত ছবি

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলা ঘুরে গ্রামীণ পরিবর্তনের এমন দারুণ চিত্র দেখা গেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে রংপুর বিভাগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনের তথ্য মতে, রংপুর বিভাগের ৪৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয়ের হিসাবেও রংপুরের ৪৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র বলে উঠে এসেছে।

এসব এলাকার মানুষের দরিদ্র হওয়ার অন্যতম কারণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আর বন্যা ও খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি এখানে। চেষ্টা থাকলেও অর্থের অভাবে কোনো উদ্যোগ সহজে গড়ে উঠতে পারে না। অবকাঠামোরও অপ্রতুলতা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘শিডিউল ব্যাংকিং স্ট্যাটেস্টিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ১১ হাজার ১৫৩টি শাখার মধ্যে মাত্র ৭৪৩টি শাখা রয়েছে রংপুর বিভাগে। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকগুলো ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে রংপুরের মানুষ পেয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ ঋণ। টাকার অঙ্কে যা ৩৫ হাজার কোটি টাকা মাত্র। দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে একসেস টু ফাইন্যান্স অনেক কঠিন।

বাংলাদেশে যে ৬২টি ব্যাংক কার্যক্রমে রয়েছে তার মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংক অন্যতম। বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা এই ব্যাংকটির উদ্যোক্তা এবং তাদের নির্দেশনায় ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের সেবার আওতায় আনতে এনআরবিসি ব্যাংক সর্বপ্রথম বাংলাদেশে উপ-শাখা ব্যাংকিং চালু করে। স্বল্প খরচে ও স্বল্প লোকবল দিয়ে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে উপ-শাখার মাধ্যমে।

রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যপীড়িত জেলা গাইবান্ধা। কৃষিনির্ভর এই জনপদের অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট। বন্যায় ডুবে ও খরায় পুড়ে নষ্ট হয় ফসল। বিকল্প কাজের জন্য গড়ে ওঠেনি শিল্প কারখানা। নিজেরা উদ্যোগী হলেও তার জন্য বাধা অনেক। প্রধান বাধা অর্থের জোগান। শহর থেকে বহুদূর হওয়ায় আর ছোট অঙ্কের ঋণ দিতে কেউ এগিয়ে আসে না বলে অর্থের জোগান পান না তারা।

এমন গ্রামীণ অঞ্চলের দারিদ্র্য ঘুচানোর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে এনআরবিসি ব্যাংক। শহুরে জনপদের মতো প্রত্যন্ত এসব গ্রামে সহজ শর্তে কম সুদে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকটি। ঋণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে অনেককেই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে তারা। কর্মহীন জনপদগুলো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে ছোট ছোট সেই উদ্যোগগুলোর কল্যাণে। স্থানীয় ওই শিল্পগুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বদলে যেতে শুরু করেছে মানুষের ভাগ্য।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার পুঁটিমারী গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা। আগে থেকে ভেপুর মাধ্যমে কয়লা পুড়িয়ে কামারের কাজ করতেন। স্থানীয় কৃষিকাজের জন্য কাস্তে, দা বটি, এসব তৈরি করে সংসার চালানো দায় ছিল তার। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পুঁজি ছিল না। এনজিওর কাছ থেকে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কোনো উদ্যোগ চালু লাভজনক মনে হয়নি তার। পাশের বাজারে এনআরবিসি ব্যাকের উপশাখা থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সেই কামারের কাজই শুরু করলেন নতুন করে। কয়লাবিহীন হিট মেশিন বসালেন। সেই মেশিন দিয়ে তৈরি হয় বড় বড় ছুরি, ডাঁসা, দা এসব। সারা দেশের বাজারে বিক্রি হয় তার পণ্য। নিজের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলা কারখানায় কাজ করেন ১০ থেকে ১৫ জন কর্মী। তার এসব পণ্য বিক্রি ও কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে আরও ১০০ জনের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে।

মোস্তাফা বলেন, প্রকৃতিগত নানা কারণে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দারিদ্র্যপীড়িত। কৃষির বাইরে কোনো কাজের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। কামার হিসেবে আমি সবসময় কাজ পেতাম না। মাঝে মাঝে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। এই হিট মেশিন বসানোর পর আমার জীবন বদলে গেছে। তবে আমি এখানেই থামতে চাই না। আরও বড় কিছু করে এলাকার মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে চাই।

গাইবান্ধার আরেক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম আরিফ খাঁ বাসুদেবপুর। সরু রাস্তা ধরে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম। সেখানে মাঠে ধান কাটা হয়েছে মাসখানেক আগে। নিচু জমিতে অন্যকোনো ফসল হয় না বলে পরবর্তী ধান রোপণের জন্য আরও ১ মাস অনাবাদি থাকত জমিগুলো। কিন্তু বিশ্রান্ত এ গ্রামের ‘মক্কা মৃত্তিকালয়’ যেন কর্মচঞ্চল এক কারখানা। মাটি কাটা, কাদা তৈরি, কাদা থেকে বাসনপত্র তৈরি, রোদে শুকানো, আগুনে পোড়ানো, সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন ৩০ জন শ্রমিক। এই কারখানার মালিক মহিদুল ইসলাম একসময় শ্রমিক ছিলেন। শ্রমিকের জীবন থেকে এক সময় নিজ বাড়িতে কারখানার করার স্বপ্ন মাথায় আসে। কিন্তু সহায় সম্বলবিহীন মহিদুলের পক্ষে অর্থের যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। মহিদুলের এই উদ্যমী মানসিকতার কথা জেনে এগিয়ে আসে এনআরবিসি ব্যাংক। মাত্র ৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি হয়ে যান সফল উদ্যোক্তা। তার কাছ থেকে দেশের অনেক বড় বড় মিষ্টি ও দইয়ের কর্পোরেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মাটির পাত্র অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করেন। মাত্র দুই বছরে মহিদুল তার কারখানার আকার তিনগুণ বাড়িয়েছেন। পর্যায়ক্রমে বড় একটি কারখানার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা আঁখি মনি। ছোট বেলায় বাবাকে হারানো এতিম আঁখিকে ১৩ বছরেই বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার। বিয়ের পরও জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলে এসএসসি পাস করেন আঁখি। অভাবের সংসার কিছু করার চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নেন গ্রামের এ নারী। স্বপ্নবাজ নারী প্রশিক্ষণ নেন হস্তশিল্পের। ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি তৈরি শেখার পর উদ্যোক্তা হওয়ার তীব্র বাসনা জাগে তার মনে। কিন্তু অর্থাভাবে এগুতে পারছিলেন না। তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় এনআরবিসি ব্যাংক। সহজ শর্তে জামানতবিহীন কম সুদে ঋণ নেন মাত্র ৫ লাখ টাকা। ওই ঋণের টাকায় ৭টি শতরঞ্জি তৈরির তাঁত কেনেন। তবে তিনি চার দেয়ালের কোনো কারখানা করেননি। গ্রামের মানুষের বাড়িতেই বসিয়েছেন সেই তাঁত মেশিন। বাড়ির কাজের পর গ্রামের নারীরা শতরঞ্জি তৈরি করে আঁখিমনির জন্য। আঁখিমনি অর্ডারের ভিত্তিতে শতরঞ্জি সরবরাহ করেন। তার স্বপ্ন রংপুরের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের বাড়িতেই তিনি নিয়ে যাবেন তার কারখানা।

দারিদ্র্যপীড়িত আরেক জনপদ রংপুরের কাউনিয়ায় আলো ছড়াচ্ছেন টাকিপুরের চাঁনমিয়া। ফেলনা জিনিসকে বানাচ্ছেন শিল্পপণ্য। মানুষের ফেলে দেওয়া চুল কিনে এনে তা দিয়ে বানাচ্ছেন চুলের ক্যাপ। দেশের বাজারের পাশাপাশি চীনে রপ্তানি আছে তার চুলের পণ্য। গ্রামে তার এই কারখানায় ১৫০ জন কাজ করেন। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী। পরোক্ষভাবে তার কারখানায় বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন আরও ৫০০ মানুষ।

চাঁনমিয়া বলেন, কাজের সন্ধানে ছুটতে গিয়ে আমরা কিছু করার চিন্তা করি। কিন্তু অর্থের যোগান সহজ ছিল না। এনআরবিসি ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে এই উদ্যোগ দাঁড় করাতে পেরেছি। আমি স্বপ্ন দেখি আমরা পুরো গ্রামকে কারখানায় রূপান্তর করব। আমার জনপদকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বের করে আনতে চাই।

কেবল চান মিয়া, আঁখি মনি, মইদুল বা মোস্তফা নয়- এমন ৬৪ হাজার উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছাতে পেরেছে এনআরবিসি ব্যাংক। বিতরণ করেছে ২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু করে এনআরবিসি ব্যাংক এমন জনপদে ছুটে চলেছে যেখানে কোনো ব্যাংক এখন পর্যন্ত সেবা নিয়ে যায়নি।

বাংলাদেশের গ্রাম উন্নয়নের চিন্তা আসে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে। এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমাল বলেন, এই ব্যাংক ৫৩ জন প্রবাসী উদ্যোক্তা মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে ব্যাংক মূলত জনগণের প্রতিষ্ঠান। আমাদের স্বপ্ন ছিল জনগণের টাকা জনকল্যাণে খরচ করা। অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আমরা গ্রামকে বেছে নিয়েছি। আমরা প্রত্যন্ত একটি গ্রামের কয়েকজনকে উদ্যোক্তা বানানোর মাধ্যমে পুরো গ্রামবাসীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। পর্যায়ক্রমে পরিসর বাড়িয়ে পুরো এলাকার উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই।

তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ব্যবসায়িকভাবে সফল করতে আমরা উপ-শাখা চালু করেছি। স্বল্প খরচে ছোট জায়গায় অল্প সংখ্যক কর্মী দিয়ে আমরা প্রত্যন্ত জনপদে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। দারিদ্র্যের সঙ্গে এই যুদ্ধে আমরা সফল হতে চাই। নিঃস্ব মানুষদের স্বাবলম্বী করতে চাই। গোটা বাংলাদেশকে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামোর আওতায় আনতে চাই।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১২:১৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০২৩

bankbimarkhobor.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

[abm_bangladesh_map]
advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

সম্পাদক
মোঃ ইসলাম শেখ
কার্যালয়

৭৯, সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড, (৩য় তলা, বাম দিক), সিদ্ধেশ্বরী, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭

01760742336

[email protected]