
অর্থনীতি ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩ | প্রিন্ট | 44 বার পঠিত
সংগৃহীত ছবি
১০ অক্টোবর, সকাল ৮টা। রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর স্কুলের পাশের কাঁচাবাজার। ব্রয়লার মুরগি বিক্রেতাকে এক ক্রেতার প্রশ্ন– তিন দিন আগেই তো কিনলাম ১৮০ টাকা কেজি দরে; আজ ২০০ টাকা কেন? বিক্রেতার উত্তর– দামের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, সব জিনিসের দাম বাড়তি। পাশের আরেক ক্রেতা বললেন, কী যে শুরু হলো! মানুষ খাবে কীভাবে?
সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের এ আলোচনা অর্থনীতির বাইরের কিছু নয়। মানুষ কর্মস্থলে, চায়ের দোকানে কিংবা গণপরিবহনে সারাদিন যেসব বিষয়ে কথা বলছে, তার অনেক কিছুই অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে রয়েছে অর্থনীতি। অথচ আমাদের দেশে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বহুমতের চর্চা নেই বললেই চলে। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়ার আগ্রহ একেবারেই কম। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনের মতামতও সাধারণত নেওয়া হয় না। অনেক সময় নতুন আইন বা বিধিবিধান প্রণয়নের আগে অংশীজন তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ পান না। কিছু ক্ষেত্রে মতামত নিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে এর প্রতিফলন খুব কম থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতে যেসব সংকট চলছে, তার সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নীতিনির্ধারকরা অনেক সময় সংকটকেই স্বীকার করতে চান না। স্বীকার না করার কারণে সংকটের সমাধানেও বহুমতের অংশগ্রহণ সীমিত।
বর্তমানে ডলার সংকটের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকগুলোর মতামত উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ডলারের দর কৃত্রিমভাবে ধরে রাখে। অ্যাডহক ভিত্তিতে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে নিবিড় পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়নি। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার পেছনে এ প্রবণতার দায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ডলারের দর ধরে রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, তখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে টাকার ২০ শতাংশের মতো দরপতন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তি দেখিয়েছিল, ডলারের দর বাড়তে দিলে আমদানি ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। দেখা গেল, বাজারে ডলারের যে চাহিদা, তাতে কাগজে-কলমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দর দেখানো হলেও বাস্তবে কেনাবেচা হচ্ছে আরও বেশি দরে। বাড়তি অংশের জন্য ব্যাংকিং খাতেই একটি অবৈধ লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, প্রবাসীদের মধ্যে হুন্ডির আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বিদেশে কাজের জন্য যখন আগের চেয়ে বেশি মানুষ যাচ্ছে, তখন উল্টো রেমিট্যান্স কমছে। এসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝেমধ্যে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু দেশে ডলারের সংকট যখন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, তখন নীতিনির্ধারকরা ‘এই তো ঠিক হয়ে যাচ্ছে, অচিরেই সংকট কেটে যাচ্ছে’– এ জাতীয় কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে অস্থিরতা কমবে। প্রথমে ডলারের দর কিছুটা বাড়বে, কিন্তু একটা পর্যায়ে স্থিতিশীল হবে। বাজারভিত্তিক হলে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং রপ্তানি আয় দেরিতে আনার প্রবণতা কমবে। অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব। তবে অংশীজন এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নানা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ উঠে আসে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মনে হয়েছে, অর্থনীতিবিদদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। এ কারণে কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের সঙ্গে বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা এখন যা বলছেন, আগেও তাই বলেছেন। নীতিনির্ধারণে তাদের পরামর্শ খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। দেশে অর্থনৈতিক সংকট বিশেষত উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে থাকা অর্থ মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে সংকটের কারণ অনুধাবন, বিশ্লেষণ কিংবা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করেনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।
সার্বিকভাবে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকট নিয়ে আলোচনার আগ্রহ একেবারেই কম। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকেও অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের তেমন উদ্যোগ নেই। জাতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ একেবারেই সীমিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ে গত কয়েকটি সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্যরা কথা বলেছেন। তারা বাণিজ্যমন্ত্রীকে তুলাধুনা করেছেন এবং তাঁর পদত্যাগ চেয়েছেন; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্টভাবে পরামর্শ দেননি।
সরকারের এক বছরের আর্থিক পরিকল্পনা হলো জাতীয় বাজেট। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ কম। বাজেট পেশের পর সংসদে কিছু আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় বাজেট প্রস্তাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকে না। তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বাজেট নিয়ে আলোচনা হয় না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কথা শোনা যায় না। মোট কথা, রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশের প্রধান আর্থিক দলিল নিয়ে নিবিড় চর্চা হয় না। ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপের ওপেন বাজেট ইনডেক্স অনুসারে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রক্রিয়া জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। গত বছর জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে বাংলাদেশের বাজেট ১০০ নম্বরের মধ্যে পায় মাত্র ১৩ নম্বর।
এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকদূর এগিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের চলমান উন্নয়নের আখ্যানকে স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের জনমানুষের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে আসছে।
তৃণমূলের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা : পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাবনা’ শিরোনামে একটি প্রকাশনা বের করেছে। এতে বলা হয়েছে, নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ভূমিকা সংকুচিত হওয়ার ফলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। সমাজের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে মধ্যবিত্ত সমাজের যে ভূমিকা ছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা এখন উপেক্ষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নাগরিকরা তাদের স্থানীয় নেতৃত্ব এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না বলেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।
Posted ১:২৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
bankbimarkhobor.com | Mr. Islam