
| বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫ | প্রিন্ট | 48 বার পঠিত
তৃতীয় দফা আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সময় পাওয়ার অপেক্ষা
রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কে ছাড় পেতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ সরকার। এক্ষেত্রে দেশটি থেকে গম, এলএনজি ও উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। তাছাড়া এলএনজি কেনার চুক্তিও করা হয়েছে, প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ কেনার। পাশাপাশি শুল্ক ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে তৃতীয় দফায় আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনের কাছে সময় চেয়েছে ঢাকা। যদিও এখন পর্যন্ত আলোচনার তারিখ জানানো হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে লবিস্ট নিয়োগের দাবি জানানো হচ্ছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এক্ষেত্রে লবিস্ট নিয়োগের প্রসঙ্গ নেই। কারণ লম্বা সময় নিয়ে কোনো নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে এ ধরনের লবিস্ট নিয়োগ করা হয়। এখানে যা করতে হবে দ্রুত করতে হবে। ওরা তো ঢুকতেই পারবে না, ওই অফিসের কাছাকাছি। নেগোসিয়েশন তো দূরের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ভালো ইমেজ আছে। সম্প্রতি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি, মেটলাইফের কতগুলো বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ইউএস চেম্বার আমাকে চিঠি লিখেছে।’
দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে দেশে বছরে গমের চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই সিংহভাগ গম আমদানি করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাদ্যপণ্যটি আমদানি হয়েছিল ৬৬ লাখ টন গম। আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৬০ লাখ টন আমদানি হয়েছে। দেশে আমদানি করা গমের আবার ৬০ শতাংশের বেশি আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। তাছাড়া কানাডা, আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও গম আমদানি করে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির জন্য গত সোমবার সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গম আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার দুইদিন পরই গতকাল দেশটি থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ৮১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫০ টাকা। সচিবালয়ে অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত এবং সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ইউএস হুইটস অ্যাসোসিয়েটসের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের কাছ থেকে এ গম কেনা হবে। প্রতি টনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০২ দশমিক ৭৫ ডলার। এর আগে গত ২৫ জুন অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেরেল কর্পস ট্রেডিং এলএলসির কাছ থেকে ৫০ হাজার টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭৫ ডলার। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আনতে প্রতি টনে বাড়তি ২৭ দশমিক ৭৫ ডলার ব্যয় করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গম উচ্চ আমিষযুক্ত হওয়ার কারণে এর দাম কিছুটা বেশি পড়ে। বাংলাদেশ কম আমিষযুক্ত গম বেশি আমদানি করে থাকে, যার দাম কিছুটা কম। বিশ্বব্যাংকের জুলাইয়ের পিংকশিটের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ২০২৪ সালে ছিল টনপ্রতি ২৬৮ দশমিক ৭ ডলার। আর এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ২৫৮ ডলার এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২৪২ দশমিক ২ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের কম আমিষযুক্ত গমের গড় দাম ২০২৪ সালে ছিল টনপ্রতি ২৩০ দশমিক ৯ ডলার। এ বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে এ গমের টনপ্রতি দাম ছিল যথাক্রমে ২৩৩ দশমিক ৯ ও ২১৯ দশমিক ৪ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির বিষয়ে গতকাল সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আনার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর যুক্তি হচ্ছে আমরা একটু ডাইভার্সিফাই করতে চাচ্ছি। অনেক সময় রাশিয়ান ব্লক কিংবা ইউক্রেন ব্লকে একটা অনিশ্চয়তা দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন আমাদের আমদানি বাড়ানোর নেগোসিয়েশন চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান ভালো।’
যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম তুলনামূলক বেশি কিনা, জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দাম একটু বেশি হলেও আমরা অন্যদিক দিয়ে সুবিধা পাব। এ গমের (যুক্তরাষ্ট্র) প্রোটিনও কিছুটা বেশি। প্রোটিন খুব বেশি তা নয়, তবে একটু বেশি।’
জ্বালানি চাহিদা মেটাতে দেশে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। কাতার ও ওমানের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদে স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানিটি আমদানি করা হয়ে থাকে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে ৫৮ লাখ টন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাঝেমধ্যে স্পট মার্কেটের মাধ্যমেও তা আমদানি করে বাংলাদেশ। এ বছরের জানুয়ারিতে দেশটির আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি কিনতে সরকার একটি হেডস অব এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেছে। হেডস অব এগ্রিমেন্ট (এইচওএ) পূর্ণাঙ্গ বা বাধ্যতামূলক না হলেও পূর্ণাঙ্গ চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ। মার্কিন শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশ সরকার বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর অংশ হিসেবে দেশটি থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ বিমানের জন্য আরো বেশকিছু উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে। মার্কিন সংস্থা বোয়িং এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়। ট্রাম্পের শুল্কারোপের পর বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটিকে উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি এখনো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পাঠানো অবস্থানপত্রটি ২১ পৃষ্ঠার নথি। এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে বড় আকারের ট্যারিফ শিডিউল। সেই সঙ্গে তৃতীয় দফা আলোচনার সময় চাওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। সবগুলো প্রক্রিয়া শেষে ডাক পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, এখন পর্যন্ত খুব বেশিসংখ্যক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রসর হতে পারেনি। পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশের মতো এত যুক্তও হতে পারেনি অন্য কোনো দেশ। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই সময় দেবে কিন্তু সবাইকে সমন্বয় করার পর হয়তো দেবে। খুব বেশি না হলেও নিশ্চয়ই আরো দুই-একটি দেশ আছে যারা সময় চাচ্ছে।
জানা গেছে, এর আগে দুই দফা আলোচনায় ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের ওপরে নেগোসিয়েশন সম্পন্ন করা হয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কান্ট্রি স্পেসিফিক প্রস্তাব দেয়া হয় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য। সুনির্দিষ্ট সেই প্রস্তাবে আগে পণ্য বাণিজ্যের পাশাপাশি এখন সেবার বিষয়গুলোও রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যে কাজগুলো এরই মধ্যে করেছে, সেগুলোও পৃথক চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। সামগ্রিক অগ্রগতি উল্লেখ করে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের একটি চিঠিও পৃথকভাবে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ অ্যাম্বাসেডর জেমিসন গ্রিয়ারকে দেয়া হয়েছে গত মঙ্গলবার।
এ বিষয়ে সেদিন রাতে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যতটা অগ্রসর হয়েছে—যেমন গম ক্রয়ের চুক্তি করছি, এলএনজির জন্য চুক্তি করছি, বিমান ক্রয়ের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছি, এ বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য এরই মধ্যে যা করা হয়েছে, সেগুলোও জানানো হয়েছে পত্র দিয়ে। তাদের সঙ্গে পরবর্তী নেগোসিয়েশনের জন্য সময় জানাতেও অনুরোধ করা হয়েছে।’
এদিকে ২২ জুলাই হোয়াইট হাউজ দপ্তরের ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি শীর্ষক ফ্যাক্ট শিট প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে যে পর্যায়ক্রমে আলোচনার পর তারা চুক্তি স্বাক্ষর করবে। কিন্তু দুই দেশের চূড়ান্ত অবস্থান গতকালই ঘোষণা দেয়া হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গেও একই ধরনের কোনো ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আশা করা যাচ্ছে আগামী দুই-একদিনের মধ্যে বাংলাদেশকে সময় দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রাতে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পরবর্তী নেগোসিয়েশনের জন্য গতকাল (২২ জুলাই) আমরা সময় চেয়েছি। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) এখনো কিছু জানায়নি।’
Posted ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
bankbimarkhobor.com | Mr. Islam